সবাক বাংলা ডেস্ক: শহুরে জীবনের ভীষণ ব্যস্ততায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। আর গোটা বিশ্বে প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে নগরের পরিধি। প্রযুক্তি ছাড়া এখানে একটা মুহূর্ত অসম্ভব মনে হয়। গোটা পৃথিবী যখন আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে প্রায়, তখন পৃথিবীর অনেক জায়গায় বাস করছে আধুনিক সভ্যতা বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ।
যাদের কথা অনেকেই জানিনা আমরা এমন একটি শহর লা রিনকোনাডা। এটি শুনতে শহর হলেও একটি শহরে যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় বা থেকে থাকে বলা যেতে পারে তার খুব সামান্যই আছে এই শহরে। কিন্তু তারপরেও এই শহরে ধীরে ধীরে বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে শহরের পরিধিও। আর এইসব কিছুর পিছনে রয়েছে একটিমাত্র কারণ। এবং তা হলো স্বর্ণ বা সোনা। বলতে গেলে স্বর্ণই বাঁচিয়ে রেখেছে এই শহরকে এবং এই শহরের মানুষদের। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই নগরটির সম্পর্কে।
লা রিনকোনাডা এই শহরটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত শহর। আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে নির্মিত স্থায়ী মানববসতি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরের উচ্চতা ৫১০০ মিটার বা ১৬৭৩২ ফুট। শুধুমাত্র এই উচ্চতা শুনে এই শহরের আয়তন কতটুকু তা হয়তো বোঝা নাও যেতে পারে। তবে এটি ঠিক যে আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এই শহর থেকে ৩০০ মিটার কম উচ্চ। আন্দিজ পর্বতমালার যে অংশটুকু পেরুর ভাগে পড়েছে তার শেষ প্রান্তে পেরু বলিভিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই ছোট্ট শহরটি। মাউন্ট আণানিয়ান পর্বতের গায়ে গড়ে ওঠা এই শহরটির ঠিক মাথার উপরেই রয়েছে আউচিটা নামক একটি হিমবাহ। এই হিমবাহকে 'দ্য স্লিপিং বিউটি' নামে ডাকা হয়ে থাকে। লা রিনকোনাডা আন্দিজের বিস্তৃত ধূসর, রুক্ষ পর্বতের গায়ে অবস্থিত সদা কর্মব্যস্ত একটি শহর। তবে মজার ব্যাপার এটাই যে এটি শহরে পরিণত হতে পারে তা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। বর্তমানে যেখানে শহরটি দাঁড়িয়ে আছে কয়েক দশক আগে সেখানেও স্বর্ণ সন্ধানীদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল।শুধুমাত্র দুঃসাহসী, বেপরোয়া ব্যক্তিরাই এই শহরে আসতেন এমন দুর্গম প্রতিকূল পরিবেশে সোনার সন্ধানে। পর্বত খুঁড়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। জানা যায় ৫০০ বছর আগে লা রিনকোনাডায় প্রথম স্বর্ণের সন্ধান পেয়েছিল ইনকারা। এরপর স্বর্ণের লোভে স্প্যানিশদের আগমন ঘটেছিল এই শহরে। স্প্যানিশরা বিদায় নেবার পর এই স্থানে স্থানীয় কিছু মানুষ স্বর্ণ খুজে বেরিয়েছিলেন। তবে চরম প্রতিকূল পরিবেশ হওয়ায় দুঃসাহসিক ও বেপরোয়া কিছু মানুষ ছাড়া এই স্থানে খুব একটা কেউ পা রাখত না। তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে বিংশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ। দরিদ্র কিছু মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছিল লা রিনকোনাডায়।
এছাড়া এসেছিল লোভী মানুষের দলও। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বহু মানুষ স্বর্ণের আশায় ভিড় জমিয়েছে লা রিনকোনাডায়। প্রতি বছরই পেরুর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ আসছেন এই শহরে। স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০০১ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এই শহরের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০,০০০ এর কাছাকাছি। বর্তমানে ৫০,০০০ এর মতো জনসংখ্যা এই শহরটিতে। সরু, দুর্গম পথ পেয়ে ক্লান্তিকর যাত্রার পর পৌঁছতে হয় এই শহরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় এখানে বাতাসের চাপ ও অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম। সেইসাথে রয়েছে প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া। এখানকার গড় তাপমাত্রা ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যে কারণে এখানে সবুজের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় না।
গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত এবং শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া ছাড়াও লা রিনকোনাডায় দিন এবং রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য রয়েছে। রাতেরবেলা তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়, তুষারপাত হয় নিয়মিত। এই শহরটিকে দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে ফেলা যাবে না কখনোই। এই শহরটিতে পরবর্তীতে যারা এসে বসবাস শুরু করেছিল তাদেরও খুব একটা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। যে কারণে অপরিকল্পিতভাবেই গড়ে উঠেছিল শহরটি। টিন, কাঠ পলিথিন দিয়ে কোনো রকমে গড়ে তোলা হয়েছে এখানকার ঝুপরি ঘরগুলি। খুব কম বাড়িই এখানে ইটের তৈরি। এই শহরে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বলে কিছুই নেই। নেই প্রশাসন বা আইন ব্যবস্থা, নেই কোন বিশুদ্ধ জলের পরিষেবা। এমনকি নেই পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থাও। আবর্জনা ফেলার জায়গা না থাকায় গোটা শহরটি জুড়েই একটি আবর্জনার ভাগাড় গড়ে উঠেছে।
এখানকার বাতাসও ভীষণভাবে দূষিত। আকরিক থেকে স্বর্ণ আলাদা করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে পারদ। আকরিকের সাথে মেশানোর পর তাপ দিয়ে পারদ বাষ্পীভূত করার পর পাওয়া যায় বিশুদ্ধ স্বর্ণ। এই শহরের সব খনিতেই প্রায় একই পদ্ধতিতে কাজ চালানো হয়ে থাকে। ফলে একদিকে শ্বাস-প্রশ্বাস এর মাধ্যমে যেমন পারদ ঢুকছে স্থানীয়দের শরীরে, অপরদিকে বাতাসও হয়ে উঠছে দিনে দিনে দূষিত। হিমবাহ গলিত জল এবং ধরে রাখা বৃষ্টির জল এখানকার বাসিন্দাদের জলের চাহিদা মেটায়। অর্থাৎ এ থেকে বোঝাই যায় এখানকার বাসিন্দারা পান করেন পারদ যুক্ত জল। যে কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা এখানকার অধিবাসীদের নিত্যসঙ্গী। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এখানকার খনির শ্রমিকদের গড় আয়ু হয় ৩০- ৩৫ বছর।
প্রশাসন ব্যবস্থা না থাকায় এই শহরটি চলছে কিছু অপরাধীদের মাধ্যমে। দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি পেরুর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অপরাধীরাও ভিড় জমাচ্ছে এই শহরে। যে কারণে নেশাজাত দ্রব্য শহরটির অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। শিশুশ্রম চলছে এখানে অবাধে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য নেই কেউই। এই পরিবেশের মধ্যেই কাজ করে যান এখানকার শ্রমিকেরা। স্বাধীনভাবেই কিছু ছোট ছোট কোম্পানি কাজ করছে এখানে। আর তাদের অধীনে যে শ্রমিকেরা কাজ করে থাকেন তাদের একটি বিশেষ চুক্তিতে কাজ করতে হয়। এই পদ্ধতিতে শ্রমিকেরা মজুরি ছাড়াই ৩০ দিন কাজ করে থাকেন। ৩১ তম দিনে কয়েক ঘন্টার জন্য দেওয়া হয় তাদের বিশেষ একটি সুযোগ। এই দিন একজন শ্রমিক যতটুকু ওজন বহন করতে সক্ষম ততটুকুই কাজ করানোর সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। এতে সামান্য পরিমাণ স্বর্ণ পেয়ে থাকেন মজুরেরা। আবার অনেকের ভাগ্যে জোটে না কিছুই। এত কিছুর পরেও লা রিনকোনাডার এই কঠিন পরিবেশে জীবন কিন্তু থেমে নেই। দুর্ঘটনায় যেমন কোন মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, তেমনি ভূমিষ্ঠ হচ্ছে নতুন শিশু। পাশাপাশা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় আরো নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে সোনার শহর এই লা রিনকোনাডায়।
Post a Comment