হীরার চেয়েও দ্বিগুন দামী এই খাবার!

খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির মধ্যে অন্যতম। তবে শুধুমাত্র চাহিদা মেটাতেই নয়, খাদ্য মানুষের কাছে বর্তমানে অন্যতম বিলাসিতাও  বটে। মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করছে এই বিলাসিতায়। প্রচলিত আছে, ব্রিটিশ রাজপরিবারে এক ধরনের পায়রার মাংস খাওয়া হয়, যার দাম প্রায় ৮ লক্ষ টাকা। তবে সেটি রাজপরিবারের খাবার। বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান খাবারের তকমাটি পেয়েছে 'স্টার্জন' নামক এক সামুদ্রিক মাছের ডিম। সেই ডিমকে বলা হয়ে থাকে 'ক্যাভিয়ার'। কি এমন আছে এই খাবারটিতে যার জন্য এর মূল্য এমন আকাশছোঁয়া? জেনে নেওয়া যাক এই ক্যাভিয়ার খাবারটি বিষয়ে।


বর্তমানে ক্যাভিয়ার এক বিলাসবহুল খাবারের তালিকায় উঠলেও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এটি ছিল নিতান্তই সাধারণ এক খাবার। 'ক্যাভিয়ার' হল এক ধরনের সামুদ্রিক মাছের অনিষিক্ত ডিম। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাদ্য সামগ্রির মধ্যে ক্যাভিয়ার হল সবচেয়ে মূল্যবান। ১ কেজি ক্যাভিয়ার এর দাম ৩০,০০০ মার্কিন ডলার বা ভারতীয় টাকায় প্রায় ২৬,০০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ক্যাভিয়ার হল স্টার্জন নামক এক সামুদ্রিক মাছের ডিম। এটি প্রধানত সামান্য পরিমাণে লবণ মিশিয়ে বা হালকা মশলা যুক্ত করে কাঁচা অবস্থায় পরিবেশন করা হয়। প্রজাতিগত পার্থক্যের দরুন ক্যাভিয়ারের আকার ও স্বাদ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। সেই সাথে রংও বদলায়। কালো, সবুজ, ধূসর বাদামী, আলকাতরা, হলুদ, গাঢ় হলুদ বা কমলা প্রভৃতি বর্ণের ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় তবে কালো বর্ণের যে ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় সেটি সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন। তাই রেস্টুরেন্টে বা বাজারে এর দাম সবচেয়ে বেশি।

প্রকৃতি থেকে এই ডিম সংগ্রহ করা হয় যখন স্টার্জন প্রজাতির মাছ প্রজননের তাগিদে সমুদ্র থেকে নদীতে আসে। অন্যদিকে খামারে চাষাবাদের সময়ে ক্যাভিয়ার সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত সময় বের করতে নির্ভর করা হয় আল্ট্রা সাউন্ড রেডিওলজির(Ultra Sound Radiology) উপর। সাধারণত স্টার্জন মাছ এক ঋতুতে কয়েক মিলিয়ন ডিম উৎপাদন করতে পারে।২০০৪ সাল অবধি ক্যাভিয়ার উৎপাদনে খামার ছিল মাত্র দুটি। কয়েক বছরের ব্যবধানে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০০ এরও বেশি। ক্যাভিয়ারের এই আকাশছোঁয়া দামের কারণ হলো ক্রেতার ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে স্টার্জন মাছের অপর্যাপ্ততা। একটি স্টার্জন মাছের প্রাপ্তবয়স্ক হতে সময় লাগে প্রায় কুড়ি বছর। তাছাড়া ডিম আসার পর ডিম নিষিক্ত হওয়ার আগেই মাছের ডিম সনাক্ত করাও সহজ কাজ নয়। প্রধানত মাছকে মেরে মাছের পেট কেটে মাছের ডিমগুলি বের করা হত। তবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কল্যাণে বর্তমানে মাছ না মেরেও ডিম সংগ্রহের উপায় এসেছে। স্টার্জন হল এক ধরনের ক্যাটফিস। প্রকৃতিতে অনেক ক্যাটফিস ১০০ বছরেরও বেশি বাঁচতে পারে।


এই মাছের বেশ কয়েকটি প্রজাতিও রয়েছে। প্রকৃতিতে প্রায় ২৬ ধরনের প্রজাতি পাওয়া যায়। স্টার্জন মাছ শীতকালের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডিম দেয়। ডিম পাড়ার ঋতুতে এদেরকে নদীর মোহনায় তথা স্বাদু জলে চলে আসতে হয়। বছরের অন্যান্য সময়ে এরা সমুদ্রেই থাকে। স্টার্জন মাছ ডিম দেওয়ার জন্য মোহনায় আসলে ক্যাভিয়ার সংগ্রহকারীরা এই মাছ শিকার করে। বহুকাল ধরেই ডিম সংগ্রহ করার জন্য স্টার্জন মাছের পেট কেটে ডিম বের করা হয়ে থাকে। কারণ পরিপুষ্ট হয়ে যদি মাছের পেট থেকে বের হয় ডিম তাহলে সে কি ক্যাভিয়ার নয়। সেটি কাঁচা খাওয়াও যায় না। অতিরিক্ত ডিম সংগ্রহের ফলে বর্তমানে বেশ কিছু প্রজাতির স্টার্জন মাছ বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে 'বেলুগা স্টার্জন'। কালো রঙের ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় এই প্রজাতির স্টার্জন মাছের থেকেই। বেলুগা স্টার্জনের ওজন প্রায় ১০০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ মাছের মোট ওজনের ১২ শতাংশ ডিম থাকে। এই ডিম তথা ক্যাভিয়ার মাছের সবচেয়ে সুস্বাদু ও দামি অংশ।

ক্যাভিয়ারের বিকল্প হিসেবে ফ্লাইং ফিশ বা অন্যান্য প্রভৃতি ডিম ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সালমন মাছের ডিম। বিশ্বের শতকরা ৯০ ভাগ ক্যাভিয়ার আসে ক্যাস্পিয়ান সমুদ্র থেকে। ভূমধ্যসাগর, উত্তর গোলার্ধের সাগরেও ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় তবে যে প্রজাতির স্টার্জন মাছ ক্যাভিয়ারের জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেটি বাস করে ক্যাস্পিয়ান সমুদ্রে। অতিরিক্ত শিকারের কারণে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকায় বেলুগা স্টার্জন মাছ শিকার করা ২০০৫ সাল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ক্যাভিয়ার প্রস্তুতিতে ডিমগুলিকে খুব সাবধানতার সঙ্গে আলগা করা হয়, যাতে সেগুলি গলে না যায় বা একটার সাথে আরেকটা লেগে না থাকে। তারপর ডিমগুলিকে লবণ ও চাটনি দিয়ে রসিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে হালকা রসুনের সাথে যুক্ত করে ক্যাভিয়ার খেতে পছন্দ করে থাকেন।


যেহেতু এটি কাঁচা পরিবেশন করা হয় তাই এটিকে খুব সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করা হয় যাতে অণুজীব প্রবেশ না করে। সাধারণত ক্যাভিয়ারকে ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়। তবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য আরো কম তাপমাত্রায় হিমায়িত করে রাখতে হয়। ক্যাভিয়ারকে বলা হয় ধনীদের খাবার। প্রতিবছর বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানি শুধুমাত্র তাদের প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য বিশ্বের ক্যাভিয়ার রিজার্ভের অর্ধেক কিনে থাকে। তবে পূর্বে এটি ধনীদের খাবার ছিল না। এক সময় রাশিয়া থেকে আগত জেলেদের এটি ছিল নিত্যদিনের খাদ্য। সাধারণ আলুর সাথে এটিকে নিয়মিত খেতেন তারা। রাশিয়ান জেলেদের সাথে নামকরণ করে ক্যাভিয়ারকে 'রো' নামেও ডাকা হতো। ইউরোপের দেশগুলিতে একসময় এটি একটি সাধারণ খাবার হিসেবেই প্রচলিত ছিল। বিগত কয়েক দশকের ক্যাভিয়ারের অত্যাধিক চাহিদা এর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। এত দামি খাবারের পরিবেশনও আভিজাত্য সম্পন্ন হওয়া উচিত। বিভিন্ন রেস্তোরাগুলিতে ২৪ ক্যারেটের সোনার বাক্সে ভরে কিংবা মুক্তোর দানার উপরে করে গ্রাহকের সামনে আনা হয়। সাধারণত প্রতিটি বাটিতে ৫০-২৫০ গ্রাম পর্যন্ত ক্যাভিয়ার থাকে।

বরফকুচির ওপর ছোট ছোট কুকি জাতীয় বিস্কুট কিংবা ধাতুর চামচের ওপর রেখে প্যানকেক, টোস্ট ইত্যাদির সাথে এটি পরিবেশন করা হয়। কেউ কেউ আবার পার্টিতে হুইস্কির সঙ্গেও নিতে পছন্দ করে থাকেন। ক্যাভিয়ার কেবল দেখতেই আকর্ষণীয় নয় এর স্বাদ যে অসাধারণ সেই বিষয়ে খাদ্য বিশেষজ্ঞদেরও কোন দ্বিমত নেই। যে খাবার সোনার বাটিতে করে পরিবেশন করা হয়, যে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছও রেহাই পায় না তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে হওয়া অতি স্বাভাবিক। প্রতি ৫০ গ্রাম ক্যাভিয়ারের দাম ১৮০০ মার্কিন ডলার থেকে শুরু হয়। আর যদি ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার বা কালো ক্যাভিয়ার হয় তবে তার দাম ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি মূল্য হয়ে থাকে। যেকোনো বড় অভিজাত পরিবারের পার্টিতে ক্যাভিয়ার থাকাটা আবশ্যিক। পশ্চিমী দেশগুলিতে সেখানকার মানুষ এটিকে হুইস্কির সঙ্গে নিতে পছন্দ করে থাকেন।


শেক্সপিয়র তিনি তার একটি নাটকে এই ক্যাভিয়ারের উল্লেখ করেছিলেন। একথা অনেকেরই হয়তো অজানা, ক্যাভিয়ারে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। এটি রক্ত সংবহনে উন্নতি করে, শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিজেন রূপে কাজ করে, হাড়ের স্বাস্থ্যে উন্নতি করে, স্ট্রেস কমায়, ত্বকের লাবণ্য বৃদ্ধি করে, বিভিন্ন ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega 3 fatty acid) সমৃদ্ধ ক্যাভিয়ার শরীরে রক্ত জমাট হতে বাঁধা দেয়, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও এটি অনন্য। ভিটামিনে ভরপুর এই খাদ্য মানব শরীরে সমস্ত ভিটামিন পূরণ করে থাকে। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন C, ভিটামিন A ভিটামিন E রয়েছে। তাই স্বাস্থ্যগত গুণ বিবেচনা করলে ক্যাভিয়ার অন্যান্য খাবারই বটে।

তবে পরিশেষে যেটি না বললেই নয় সেটি হল, পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে খুব দ্রুতই বিলীন হয়ে যাবে এই স্টার্জন প্রজাতির মাছ। তখন হয়তো প্রচুর অর্থ বা কোন কিছুর বিনিময়েই মিলবে না প্রকৃতির এই সম্পদ। আর শুধুমাত্র বিলাসিতার জন্য একটি অমূল্য প্রজাতির ধ্বংস হলে সেটি হবে প্রকৃতির সঙ্গে চূড়ান্ত অবিচার। তাই মাছ বান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করে মাছকে না মেরে ডিম বের করে নেওয়ার আধুনিক পদ্ধতিকে বাড়াতে হবে। সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে এটাই যে চাষ ব্যতীত অন্যান্যভাবে ক্যাভিয়ার সংগ্রহ বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। তবেই রক্ষা করা যাবে প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদকে।

Post a Comment

আগের খবর পরের খবর