মানুষের মহাকাশযাত্রা ঠিক কতটা রোমাঞ্চকর এবং ঝুকিপূর্ণ?

সবাক বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অবস্থিত পুরো মহাদেশই মূলত মহাকাশের অংশ। সেই মহাকাশ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বহু পূর্বেই শুরু হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বসূরীরা মহাকাশ, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ করে এসেছে। তবে পর্যবেক্ষণ করলেও মহাকাশে পৌঁছানো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে মাত্র ৬০ বছর আগে। আর সব যাত্রার মত মানুষের এই মহাকাশযাত্রা কিন্তু অতটাও সহজ ছিল না। পাশাপাশি এই মহাকাশযাত্রা ছিল যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি বিপদসংকুল। জেনে নেওয়া যাক মহাকাশযাত্রা করার মধ্যে ঠিক কতটা রোমাঞ্চকর ও বিপদ সংকুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল মানুষকে।


প্রথমেই আগে জেনে নেওয়া যাক মানুষের মহাকাশ পর্যন্ত পৌঁছানোর কাহিনী সম্পর্কে। বিজ্ঞানের প্রযুক্তির অগ্রগতির কল্যাণে মানুষ প্রথম মহাকাশে যাবার উপায় খুঁজে পায় উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়ে বেশি গতিতে কিছু নিক্ষেপ করা সম্ভব হলে সেই বস্তুটির পক্ষে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে পৌঁছানো সম্ভব। সমস্যা হলো ওই সময় এই উপায় জানা সত্ত্বেও মানুষের নাগালের বাইরে ছিল ওইরকম শক্তি উৎপাদনকারী ইঞ্জিন। সেই সক্ষমতা অর্জনে মানুষকে ব্যয় করতে হয় আরো প্রায় ১৫০ বছর। এর মাঝে বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন শত্রুদের ঘায়েল করার আরো কার্যকরী উপায় আবিষ্কারের ফলে মানুষ রকেট নির্মাণে সক্ষম হয়। ওই প্রযুক্তি পরবর্তী সময়ে মানুষকে মহাকাশে পৌঁছানোর সক্ষমতা দেয়। এর ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে মানুষের পাঠানো প্রথম উপগ্রহ হলো 'স্পুটনিক'।

১৯৫৭ সালের ৪ ই অক্টোবর এই ইতিহাস গড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা। একাধিক অ্যান্টেনা বিশিষ্ট গোলাকার ওই উপগ্রহটির ওজন ছিল মাএ ৮৩ কেজি ৬০০ গ্রাম। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি গড়ে তুলে দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয় যার ধারাবাহিকতায় একে একে মহাকাশে পাঠানো হয় প্রথমে কুকুর এবং এরপর বানর। এরপর ১৯৬১ সালের ১২ ই অক্টোবর প্রথমবারের জন্য মহাকাশে মানুষ পাঠিয়ে ফের ইতিহাস তৈরি করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা। ইউরি গ্যাগারিন ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ত্যাগ করে মহাকাশে পৌঁছে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করেছিলেন। মহাকাশে পৌঁছানোর পরে তাকে বহনকারী যানটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার পথে প্রায় ৪১০০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে। এভাবে ১০৮ মিনিট মহাশূন্যে বিচরণের পর নিরাপদে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসেন ইউরি গ্যাগারিন।


এর প্রায় দু'বছর পরে প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশে যাবার রেকর্ড অর্জন করেন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। ১৯৬৩ সালে তিনি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ত্যাগ করেছিলেন। এরপর ভ্যালেন্টিনার মহাকাশযানটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ৪৮ বার ঘুরপাক করে। সবমিলিয়ে প্রায় টানা ৭১ ঘণ্টা মহাশূন্যে কাটানোর পরে নিরাপদে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসেন তিনি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো অনেক মহাকাশচারী তাদের কর্মজীবনে এতটা সময় মহাশূন্যে কাটানোর সুযোগ পায়নি। মহাশূন্যে প্রথম নারী ও পুরুষ পাঠানোর প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হার শিকার করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৬৯ সালে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানুষকে চাঁদে পাঠাতে সক্ষম হয়। চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। এরপর গত ৫০ বছরে ইউরি গ্যাগারিন ও ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা উত্তরসূরী হিসেবে মহাশূন্যে পৌঁছতে পেরেছেন ৫৬৩ জন যাদের মধ্যে ৪৯৯ জন ছিল পুরুষ ও ৬৪ জন ছিল নারী। সবমিলিয়ে তারা মহাকাশে কাটিয়েছেন প্রায় ১০০০০ কর্মদিবস। আর এর মধ্যে মহাকাশযানের বাইরে তাদের ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ১০০০ ঘন্টার মতো সময়। যদিও এ থেকে সফলতার ছবি দেখা গেলেও বাস্তব চিত্রটা কিন্তু এমন নয়।

আরও পড়ুন: হীরার চেয়েও দ্বিগুন দামী এই খাবার!

বাস্তবতায় হল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে পুরো মহাবিশ্ব মানুষের জন্য প্রাণঘাতী। এখানে না আছে জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন, না আছে মাধ্যাকর্ষণ প্রভাব, এমনকি শুধু ভূপৃষ্ঠে অভ্যস্ত বায়ুচাপে অনুপস্থিতি থাকায় অরক্ষিত অবস্থায় মহাকাশে আমাদের শরীরে প্রবাহমান রক্ত বাষ্পে পরিণত হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একটি ঘটনার কথা। ইতালির মহাকাশযাত্রী লুকা পারমিতানো ২০১৩ সালে  মহাশূন্যে ভ্রমণের সময় হঠাৎই টের পান তার হেলমেটে জল ঢুকছে  এটা শুনে ভাবছেন হয়তো মহাশূন্যে জল কোথা থেকে আসবে? আসলে তার প্রতিরক্ষা শ্যুটটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পাইপে একটি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছিল। যেখানে চুইয়ে বের হওয়া জল পারমিতানোর হেলমেটে প্রবেশ করছিল। মহাকাশে কোন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখযোগ্য প্রভাব না থাকায় ভূপৃষ্ঠের মতো জল নিচের দিকে জমা হয় না বরং তা ভেসে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এর জন্যই পারমিতানোর হেলমেটে জল প্রবেশ করছিল। মহাশূন্যে থাকায় সেই হেলমেট খুলে জল বের করে নেওয়াও সম্ভব ছিল না। আর তিনি কিছু দেখতেও পাচ্ছিলেন না। তবে উপস্থিত বুদ্ধি না হারিয়ে তিনি তার বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির জোরে নিজ মহাকাশযানে ফিরে গিয়েছিলেন।


মহাকাশে হাঁটার সময় প্রতিরক্ষা শ্যুটটিতে কোন ক্ষত সৃষ্টি হলে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে। কারণ ওই শ্যুটটির মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ ও বায়ুচাপ সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি হয়ে থাকে। কোনো কারণে অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের বেশি সচেতন থাকা সম্ভব নয়। আর বায়ুচাপ সংরক্ষণে ত্রুটি দেখা দিলে মানুষের রক্তে বিদ্ধমান গ্যাসকণিকাগুলি সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় মহাকাশচারীর শরীর দ্বিগুনেরও বেশি ফুলে উঠতে পারে। ১৯৬০ সালে US বিমান বাহিনীর পাইলট জোসেফ ক্যাটিংগার্ড এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বায়ুমন্ডলের সর্বোচ্চ স্তর স্ট্যাটোস্ফিয়ার থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। ভূপৃষ্ঠে নেমে আসার পথে তার ডান হাতের দস্তানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ফলে তার ডান হাত ফুলে গিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসায় কোন দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে। তাছাড়া বায়ুচাপ হ্রাস পাওয়ায় স্ফুটনাঙ্ক স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নেমে আসে। ১৯৬৬ সালে নাসার পরীক্ষাগারে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় এক নভোচারীর প্রতিরক্ষাকারী শ্যুটটি ছিড়ে গিয়েছিল। এর কারণে বায়ুচাপ হারিয়ে ফেলায় মুখে থাকা লালা ফুটতে শুরু করেছিল বলে জানিয়েছিলেন ওই নভোচারী।


মহাকাশ ভ্রমণের সময় খালি চোখে দেখা যায় না এমন ধূলিকণার আঘাতেও ভয়াবহ বিপদ সৃষ্টি হতে পারে। এই কনাগুলি অকল্পনীয় গতির অধিকারী। বিজ্ঞানীদের হিসেবে এই ধূলিকণার গতি প্রতি ঘন্টায় ৩৬০০০ কিমি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া মহাকাশযাত্রা শেষে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসার সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মহাকাশযান ছাড়া কোন ব্যক্তি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে প্রচন্ড ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন তাপমাত্রা নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এত বিপদের কারণে মহাকাশ ভ্রমণে ব্যবহৃত শ্যুটটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে থাকে। এটি পড়ে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়াও দূরুহ হয়ে পড়ে। আবার অপরদিকে মহাশূন্যে টিকে থাকার জন্য এর বিকল্প নেই। এই শ্যুটটি পড়া অবস্থায় মহাকাশ ভ্রমণের সময় দিকভ্রান্ত হয়ে পড়লে যাতে বিপদ না বাড়ে, সেই কারণে প্রাথমিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে নভোচারীরা সবসময় জোড়ায় জোড়ায় স্পেসওয়াকের কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন।


এই সময় তারা নিজেদেরকে শক্তিশালী দড়ির সাথে সংযুক্ত করে রাখেন। এরপরেও কোনো কারণে দড়িটি ছিড়ে গেলে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে সেই বিশেষ শ্যুটটিতে জেটব্যাগ যুক্ত করা থাকে। সেই  ব্যাগের সাহায্যে অল্প দূরত্ব অতিক্রম করে নিজ মহাকাশযানে ফিরে আসতে পারবেন তারা। কিন্তু যদি জেটব্যাগ কাজ না করে তবে সেক্ষেত্রে সাথে থাকা অক্সিজেনের ওপর নির্ভর করে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াতে হবে। সমস্যা হল আনুমানিক সাড়ে ৭ ঘন্টা পর সেই অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে হতভাগ্য নভোচারীকে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এরপর মহাকাশে সূর্যের আলোয় মরদেহটি অচিরেই ভূমিতে পরিণত হবে। এটা হল শ্যুট বা জেটব্যাগের সমস্যা হলে কি ঘটতে পারে তার কথা। কোন কারনে শ্যুট বা অক্সিজেন সরবরাহে গোলযোগ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ মানবদেহের জলীয় বাষ্প উবে যাবে এবং হতভাগ্য ব্যক্তি ভূমিতে পরিণত হবে। বিপদের এমন দীর্ঘ তালিকার পরেও কিন্তু এখনো পর্যন্ত মহাশূন্যে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হয়নি। এছাড়া সাবধানতা বা দুর্ভাগ্য যে কারণেই হোক এখনো পর্যন্ত হারিয়ে যাননি কোন ব্যক্তি।

Post a Comment

আগের খবর পরের খবর